আজ পয়লা অগাস্ট। চন্দ্রা মানে চন্দ্রনীর জন্মদিন। বাবা হারা মেয়েটাকে বছরভর নাহলেও এই দিনটা তে ওর কাছা কাছি থেকে ওর ইচ্ছার সাথে সামঞ্জস্য মেলাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে।তিন বাড়িতে রান্নার কাজ করে এসে মেয়ের জন্য ওর পছন্দের টুকিটাকি রান্না করে কাঁসার থালা নামায় দেওয়ালের তাক থেকে। ওই কাঁসার থালা, বাটি, গ্লাস মুখে ভাতের সময় মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে খাওয়াবে বলে ওর বাবা ওভার টাইম করেছিল সেই মাসে। ওই সময়ে জমানো চকচকে টাকার মতোই আজও চমকাচ্ছে বাসনপত্র গুলো। আরতির দুফোটা জল গড়িয়ে থালাতে পড়তেই একটা মিস্টি গন্ধ নাকে এলো। এমা! পায়েস বসিয়ে বেমালুম ভুলে গেছে ও। এক দৌড়ে হাঁটা দিয়ে পায়েস টা নেড়ে দিলো। কয়েকটা চাল তুলে টিপে দেখলো সেদ্ধ হয়ে গেছে এবার মিস্টি দিয়ে নামিয়ে নেবার আগে বছরে একবারেই এই দিনটাতেই মেয়ের পছন্দের একটু কিসমিস আর কাজু ছড়িয়ে দেবে। যেমন করে ওদের শ্যাওলা ধরা উঠোনে বছরে একবারই শরতের সকালে ছড়িয়ে থাকে শিউলি ফুল গুলো।
আসলো লক্ষীর ভাঁড় এর পাশাপাশি আরেকটা ভাঁড় জমায় আরতি। সেটায় যা জমে তাই দিয়ে একটা নতুন নাইটি, দুচারটে বেলুন,একটা মোমবাতির বাক্স , আর একটা ছোট্টখাটো কেক সাথে একটা চকলেট এটুকু কুলিয়ে যায়।চন্দ্রার শরীর টা কদিন খুব একটা ভালো ছিল না। ডাক্তার এর ওষুধ খেয়ে একটু কমে আবার কদিন পরেই শুরু হয় মরণের পেটে ব্যথা, কষ্ট, মাথা ঘোরা, জ্বর, মুখে অরুচি । সেদিন হাসপাতাল গিয়ে ইনজেকশন আর সেলাইন নিয়ে রাত দুপুরে বাড়ি ফেরে দুজনে।সেই থেকেই খুব সেদ্ধ খাবার খাছে, আজ মুখের রুচিটা একটু ফিরবে ভেবেই মুখে হাসি ফোটে সদ্য ষোলোয় পা রাখা মেয়ের মায়ের।
চন্দ্রার আজ পরীক্ষা আছে, তাই স্কুলে যেতে হয়েছে। এবছর মাধ্যমিক তাই চাপ টাও বেশি।এসব ভাবতে পৌঁছে যায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এই পেটে ব্যথার কারণে সোনোগ্রাফি করাতে বলেছিলো, সাথে রক্তের কয়েকটা টেস্ট দিয়েছিলো ডাক্তারবাবু। আজ তার রিপোর্ট দেবে। ফেরার সময় স্কুল থেকে মেয়েকে নিয়ে একদম বাড়ি ফিরবে দুজনে। তারপরই মেয়ের পছন্দের সোনার বাটিতে সাদা অমৃত পরিবেশন করবে। আসলে ছোট্ট বয়সে ওই কাঁসার বাটি দেখে বলে উঠেছিল “মা সোনার থালা বাটি কিনেছে বাবা আমার জন্য ” সবাইতো হেসে হেসে পাগল। ওকে বলে বুঝিয়েও কোনো লাভ হয়নি।সেই থেকেই কাঁসা কে সোনা ই বলে চন্দ্রা । এসব চিন্তার করতে করতেই মেয়ের নাম লেখা খামটা তুলে নিলো। আজ আরতি খুবই ব্যাস্ত। এই দিনটাতে ওর নিজের একটা প্রস্তুতি থাকে। নিজের জন্ম তারিখ না জানা মানুষের সন্তানের জন্মদিনটার জন্যই তো অপেক্ষা থাকে। কাউকে জন্ম দেওয়ার সাথে সাথে আরেকবার পুনর্জন্ম হয় সব মা —দেরই।
পড়াশোনা জানলেও ইংরেজি টা খুব একটা জানা নেই আরতির। তাই মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে জোর কদমে পা চালিয়ে বাড়ি এসেই খাম টা মেয়ের হাতে দিয়ে খুলতে বলে। খামটা খুলেই যেটা চোখে পরে সেই শব্দটার সাথে খুব একটা পরিচিত নয় ওই ষোলোর যুবতী। মা ভাতের থালা সাজিয়েছে চমৎকার। কিন্তু সেদিকে মন নেই আর বার্থডে গার্ল এর কারণ এতক্ষনে গুগল করে ও জেনে ফেলেছে ওই কঠিন শব্দ লিউকোমিয়া র সহজ নাম টা —ক্যান্সার । চোখ মুখ নীরব থমথমে, গাল বেয়ে নামছে জলের ধারা। আসন টা পেতেই আরতি খেয়াল যায় মেয়ের মুখে দিকে।খামটা টেনে নিয়ে বললো “কিরে কি লেখা আছে? কাঁদছিস কেন?”চন্দ্রা ভাঙা কান্না গলায় মা কে কোনো রকমে বলে দেয় রোগটার নাম।
তারপর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ছিল কতক্ষন তার হিসাব দুজনে কেউই রাখিনি । মাথার ওপরে শূন্য আকাশে শুধু কালো মেঘ, চারপাশ অন্ধকার। তোমায় ছেড়ে যাবো না — তোকে কোথাও যেতে দেবো না……. পাগলের মতো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কথা গুলো আউরে যাচ্ছিলো মা — মেয়ে।
দুপুরের খাবার গুলো আর মুখে ওঠেনি কারুর। চুবড়ির ভিতরে উক্কি দিচ্ছে মাছের লেজা ভাজাটা, হলুদবর্ণ ডাল, পাঁচ রকমের ভাজা। সাথে সাধের পরমান্য।
সন্ধে বেলায় পাড়ার দু তিনজন বন্ধু আসবে। আরতি জোর করেই ওদেরকে নিমন্ত্রণ করিয়ে ছিল মেয়েকে দিয়ে এবছর। কেক,আলুরদম, লুচি আর এক চামচ পায়েস এই মেনু। কাউকে বলা যাবে না এসব কথা পাড়ায় ঢি ঢি পরে যাবে তাহলে। দুপুর টা যেমন তেমন করে কাটলেও সন্ধে টায় দুজনকেই সামলাতে হবে। আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতেই পাড়ার দোকানের একটা কেক কিনলো, সাথে এক প্যাকেট বেলুন। ঘরে এসে বহু কষ্টে বেলুন দিয়ে ঘর সাজালো। চন্দ্রা মা কে ডেকে, মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ওর মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো — মন খারাপ করিস না মা। টাকার জোর না থাকতে পারে, মনের জোর সাংঘাতিক। ওদিয়েই যুদ্ধটা লড়ে নেবো আর জিতেও যাবো। দেখ তো কেক টা…….তোর পছন্দ হয়েছে।এমা মোমবাতি টাই তো আনা হয়নি, মাথা কাজ না করলে যা হয়।চন্দ্রা মুঠো খুলে দেখায়.. এই দেখো । কতগুলো একশো, দুশোর নোট সাথে চারটে পাঁচশো টাকার নোট। আরতি টাকা গুলো নিয়ে বলে “কোথায় পেলি এতো টাকা”। চন্দ্রা মা কে আরেকটু চেপে ধরে বলে “এগুলো বেশ কিছুটা স্কুলের টিফিনের জমানো টাকা, খুচরো গুলোকে দোকানে দিয়ে নোট করে নিয়েছি আর পাঁচশো গুলো.. মেহেন্দি পড়িয়েছিলাম বৈশাখ মাসে তৃনার দিদির বিয়েতে। মোট পাঁচজন কে পরিয়েছিলাম ওরা দুহাজার টাকা দিয়েছিলো। সেগুলো জমিয়ে রাখতাম আমার ড্রয়িং খাতার ভাঁজে। তোমাকেও দেখায়নি জানো মা। ভেবেছিলাম আমার ১৮ বছরের জন্মদিনে আমরা দুজনে একসাথে সমুদ্র দেখতে যাব। ততদিনে আরও কিছুটা জমে যাবে টাকা। দুজনের দিঘার পাড়ে বসে মাছ ভাজা খাবো, হাউজ বোর্ডে চড়ে সমুদ্রের বুকে গিয়ে ঢেউ গুলোর সাথে খেলবো,তোমায় একটা ঝিনুকের ধূপদানি কিনে দেবো, আর একটা ছোট্ট সুন্দর আওয়াজ হওয়া শঙ্খ। তোমার তো খুব শখ তাই না মা এরকম একটা শঙ্খর। আর নিজের জন্য একটা মুক্তোর মালা। দুটো দিন শুধু সমুদ্র তুমি আর আমি। এসব তো আর হবে না… তাই না মা। হাউমাও করে কেঁদে ওঠে আরতি। আষ্টেপৃষ্ঠে মেয়েকে চেপে ধরে বলে” সব হবে মা গো! সববববব………..ঠাকুর তুমি মুখ তুলে চাও, তোমার দেওয়া এটুকুই সম্পদ ই তো সম্বল।আমার ”
ফোন বাজছে, এদিকে চন্দ্রা ওর মা কে ছাড়ছে না। বলছে ছাড়ো তো জন্মদিনের শুভেচ্ছা নিতে আর মন চাইছে না। ফোন টা কেটে যায়, আবার বাজে। চন্দ্রা কে কোনোরকমে উঠিয়ে ফোনটায় দেখে নাম বিহীন একটা নম্বর।আরতি ফোটা তুলে কিছু বলার আগেই ওপার তর্কে শব্দ তরঙ্গ ভেসে আসে।
হ্যালো আমি কি চন্দ্রানী মন্ডল এর সাথে কথা বলছি।
না আমি ওর মা আরতির কথা বলছি।
ও আচ্ছা নমস্কার ম্যাডাম আমি ক্লিন এন্ড ক্লিয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কথা বলছি। সকালে কি আপনি এসেছিলেন আপনার মেয়ের চন্দ্রানী মন্ডলের রিপোর্টটা নিতে?
হ্যাঁ আমি তো গেছিলাম। কেন বলুন তো?
সরি ম্যাডাম একটা ভুল হয়ে গেছে। আমরা অনেক গুলো রিপোর্টের খাম রেখেছিলাম। আমরা খেয়াল করিনি হয়তো আপনিও দেখেননি ওখানে দুটো চন্দ্রানী মন্ডল নামে খামছিল। যে এনভেলপ টা আপনি নিয়ে গেছেন সেটা আপনার মেয়ের রিপোর্ট নয়। আপনার মেয়ের এজ তো ১৬ তাইনা? এখানে আর একজন চন্দ্রানী মন্ডল দাঁড়িয়ে আছেন। উনি মিডিল এজেড আই মিন ৪৫ বছর বয়স। ওনার রিপোর্টটাই আপনার কাছে চলে গেছে। কাইন্ডলি যদি ওনার রিপোর্টটা একটু আপনি নিয়ে আসেন তাহলে আমাদের খুব উপকার হয়, তাহলে আপনার মেয়ের রিপোর্টটাও নিয়ে যেতে পারবেন। বুকটা ধড়াস করে ওঠে আরতির। কিছু না বুঝে চন্দ্রা হা করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আরতি চেচিয়ে বলে ওঠে ” চন্দ্রা শিগগিরই খামটা খুলে দেখতো ওখানে কত বছর বয়স লেখা আছে রোগীর “। খামটা খুলেই হাঁ হয়ে যায় চন্দ্রা। আনন্দের চোটে লাফিয়ে উঠে বলে ” মা, আমার তো আজ ষোলো বছরের জন্মদিন , পয়তালিশ বছর তো অনেক দেরি এখনো আসতে”।
আরতি বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করে” আপনি বলতে পারবেন আমার মেয়ের কি হয়েছে? মানে রিপোর্টে কি আর লেখা আছে? বুঝতেই তো পারছেন আমরা খুব চিন্তিত’।
না না চিন্তার কোন কারণ নেই আপনার মেয়ের গ্যাসের প্রবলেম আর সাথে রক্তে হিমোগ্লোবিনটা কম। ব্যাস এটুকুই।বাদবাকিটা ডাক্তারবাবু আপনাকে সব বলে দেবেন ।
আমার মেয়ের সেরকম কিছু হয়নি আপনি সত্যি বলছেন।
আপনার মেয়ের এর চেয়ে বেশি কিছু হয়নি ম্যাডাম। আমি সত্যি বলছি।
ধন্যবাদ দিদি আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। বলছি আমি যদি কিছুক্ষণ পরে যাই রিপোর্টটা আনতে।
আমাদের রাত নটার সময় বন্ধ হয় সেন্টার। আপনি তার আগে এসে প্লিজ একটু রিপোর্টটা দিয়ে যাবেন আর আপনার রিপোর্টটাও নিয়ে যাবেন।
হ্যাঁ হ্যাঁ দিদি আমি তার আগেই যাব…আগেই আগেই যাব।
বাইরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
তাড়াতাড়ি করে নিজের চোখের জলটা মুছে মেয়ের চোখের জলটা মুছে দিয়ে বলে ওই দেখ মনে হয় বুবু, রিম্পি, মামণি ওরা চলে এসেছে। যা গিয়ে দরজাটা খোল। দরজা খুলতে যাওয়ার আগে মায়ের হাত থেকে নিজের জমানো টাকাগুলোকে নিয়ে ড্রয়িং খাতার ভাঁজে রেখে দিয়ে বলে…… মা আমরা তাহলে দীঘা যাচ্ছি! কি বলো? আরতি ওর মেয়ের মাথায় আরেকবার চুমু খায়।তখনই ঠিক আরো জোরে কড়া নাড়া শব্দ হয় দরজায়। আরতি ঠাকুর ঘরের দিকে যায় । ধুপ জ্বেলে শঙ্খ বাজিয়ে হাতজোড় করে ঠাকুরকে বলে “তুমি আবার আমায় পুনর্জন্ম দিলে ঠাকুর। ওই যে অচেনা মানুষটা চন্দ্রনী মন্ডল, তাঁকে এই মারণ রোগের হাত থেকে রক্ষা করো। ”
কেকটা টেবিলে সাজানো হয়েছে, হাওয়ায় বেলুনগুলো উড়ছে।সবার মুখে কি চমৎকার হাসি। খিলখিল করছে ওর চন্দ্রা। কেকে ছুরি ধরার আগে আরতি বলে দাঁড়া “আমি এক দৌড়ে পাশের দোকান থেকে মোমবাতি টা নিয়ে আসি।” চন্দ্রা মায়ের আঁচল টেনে ধরে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে “থাকনা মা। ওসব মোমবাতি আজকে বাদ দি। তোমার আমার খুশির আলোতে আজ কেকটা কাটি। আলোটা জ্বলুক মা,ফু দিয়ে নাই বা নেভালাম।
দুজনের চাঁদের হাসিতে ঘর তখন জমকালো। কেকের টুকরো মেয়ের মুখে দিয়ে ক্রিম টা গালে লাগিয়ে বলে…… শুভ জন্মদিন আমার ষোলোয়ানা সুন্দরী।