বাংলা গল্প ২০২২ – ‘সৌমাল্য’
লেখক – সুনীত অধিকারী
সমরেশ মুখোপাধ্যায় আজকের দিনের একজন খুবই বিখ্যাত পরিচালক ; ভারতবর্ষের এমন কোনো লোকনেই আজকের দিনে তাকে চেনে না তিনি কলকাতার ই বাসিন্দা শম্প্রতি গত দুই বছরে পাঁচ – পাঁচ খানা হিট ছবি দিয়ে তিনি খুবই জনপ্রিয় হয়েছেন |
গত সাতদিন তিনি কর্মজীবন থেকে ছুটি নিয়ে ডালহৌসি তে বেড়াতে এসেছেন বিয়ে এখুনো তিনি করেননি | গাইড নিয়ে ডালহৌসির বিখ্যাত সমস্ত জায়গা ঘুরে দেখেছেন যেমন খাজ্জার, সাতধারা ফলস, পাঁচপুলা, ডাইনোকুন্দ, কালাটপ, খাজিয়ার সংকচুয়ারি এবং আরো অনেক কিছু | আর দুদিন পর আবার কলকাতায় ফিরে যাবেন তিনি আজকের দিন টা হোটেল এ বিশ্রাম নিয়ে কাটাবেন ঠিক করেছেন |
সারাদিন হোটোলে বসে থেকে দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে তিনি ভাবলেন একবার সামনের বাজার থেকে ঘুরে আশা যাক | খুব কাছেই একটা বাজার পরে দশ মিনিট এর হাঁটা পথ এইখানে খাবার ছাড়াও আরো অনেক কিছু পাওয়া যাই যেমন পাহাড়ি জ্যাকেট, কুকরি, ইত্যাদি যেটা ওই মার্কেট বিখ্যাত সেটা হলো পাহাড়ি লাঠি এবং চুরুট ; সমরেশ বাবুর দরকার ওই চুরুট |
ভদ্রলোক বাজার থেকে চুরুট কিনে তাতে অগ্নি সংযোগ করে হোটেলের দিকে ফিরছিলেন , হটাৎ একটি দোকানের দিকে চোখ যেতেই তিনি থেমে দাঁড়ালেন | প্রায় দশ মিনিট তিনি ওই ভাবেই তাকিয়ে ছিলেন কারণ টা হলো একজন লোক যে দোকানের দিকে তিনি তাকিয়ে সেই দোকানের ভিতরে এক খদ্দের দাঁড়িয়ে কিছু কিনছেন সমরেশ বাবুর নজর সেই লোকটির দিকেই |
খদ্দেরটি বাজার থেকে বেরিয়ে একটি পার্ক আছে সেই পার্কের একটি বেঞ্চে গিয়ে বসলেন এবং মনের সুখে একটি সিগারেট ধরিয়ে তাতে টান দিতে লাগলেন | সমরেশ বাবু এই সময়তে খদ্দের্টির সঙ্গে আলাপ জমানোর উপক্রম করে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ” আমি কি এখানে একটু বসতে পারি “? ভদ্রলোকঃ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন তার দিকে তাকিয়ে ” হ্যাঁ নিশ্চই ” |
সমরেশ বাবু বসলেন দুজনের মধ্যেই বেশ কিছুক্ষন কোনো কথা নেই একজন সিগারেট টানছেন ওপর জন চুরুট টানছেন ; কিন্তু দুজনেই পরশপর কে আঁড় চোখে দেখছে |
প্রথমটা সমরেশ বাবু শুরু করলেন
” আমার নাম সমরেশ….সমরেশ মুখোপাধ্যায় থ্যাংকস ফর দা সিট… “
ভদ্রলোকঃ হেসে উত্তরে বললেন
” হেঃহেঃহেঃ….মেনশন নট….আচ্ছা আপনি কি চিত্র পরিচালক সমরেশ মুখোপাধ্যায়?? “
“আজ্ঞা হ্যাঁ..” উত্তর দিলেন সমরেশ বাবু
” আরে আপনি তো বিখ্যাত লোক মশাই…দা ফেমাস ডিরেক্টর অফ ইন্ডিয়া আমার পাশে বসে কি সৌভাগ্য ” |
ভদ্রলোকঃ কে চেপে দিয়ে সমরেশ বাবু বলে উঠলেন ” আরে আসতে বলুন হলিডে তে নো অটোগ্রাফ এর ভিড় প্লিজ “|
” ও সরি সরি ই সি… আমার নাম সৌমাল্য মল্লিক আমি এই যে সামনে পর পর দুটো হোটেল আছে সেভেন ষ্টার আর ব্লু ষ্টার ওই দুই হোটেল এর ম্যানেজার আমি , মালিক অন্যজন বাইরে থাকে দুবাই তে ” বললেন সৌমাল্য বাবু অর্থাৎ যিনি এতক্ষন খদ্দের হিসেবে পরিচিত ছিলেন |
” আমি তো ওই সেভেন ষ্টার এই উঠেছি….ভেরি গুড হোটেল ভেরি গুড সার্ভিস অল্সো ” হেসে বললেন সমরেশ বাবু |
সমরেশ বাবু এবার থাকতে না পেরে আসল কথাটা বলেই ফেললেন ” দেখুন আমি একজন চিত্র পরিচালক এইটা আপনার কাছে অজানা নয়, তাই আপনার সাথে একটা প্রস্তাব নিয়ে কথা বলতে চাই ; তার আগে বলে রাখি আপনাকে আমি বাজার থেকে ফলো করছি একটা বিশেষ কারণে…….”
সৌমাল্য বাবুর চোখে মুখে প্রশ্ন ও সন্দেহের ছাপ সে বললো ” আমার মতন কেরানির ম্যানেজার এর থেকে আপনি বিশেষ কি পেলেন কে জানে?.. হোটেল এ কোনো সমস্যা হইছে কি?? “
” না না ওই সব কিছুনা… আচ্ছা সিনেমার ব্যাপারে আপনার তো ভালোই ইন্টারেস্ট আছে মনে হচ্ছে… কখনো অভিনয় করার শখ হয়নি? ” জিজ্ঞেস করলেন সমরেশ বাবু |
তার আগে বলে রাখি সৌমাল্য বাবুর বয়েস 55 থেকে 60 এর মধ্যে, কাঁচা পাকা মেশানো চুল , লম্বাই 6 ফুট এর বেশি কিন্তু বয়েসের আন্দাজে চেহারা বেশ সুপুরুষ |
সৌমাল্য বাবু উত্তরে বললেন ” জোয়ান কালে থিয়েটার করেছি কিন্তু ওই দিয়ে তো আর পরিবার টানা যায়না ; তাই আর এগোইনি কলেজ শেষ করে চাকরি তারপর আর কি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে এখুন এখানে….. কিন্তু হটাৎ সিনেমার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক বলুন তো… ব্যাপার টা খোলসা করে বলবেন?? “
সমরেশ বাবু বললেন ” ঠান্ডা টা বেশ বাড়ছে চলুন না আমার রুম এ গিয়ে কথা বলা যাক.. ” দুজনে গিয়ে সমরেশ বাবুর রুম এ গিয়ে বসলেন সমরেশ বাবু কফি এবং চিকেন স্যান্ডউইচ অর্ডার করলেন একটু গলা খাকরানী দিয়ে বলা শুরু করলেন
” হররর, কমেডি, থ্রিলার, রোমান্টিক, রোমান্টিক কমেডি, হররর কমেডি সব রকম এর সিনেমা আমার বানানো হয়েগেছে সব কোটায় সুপারহিট নাহলে ব্লকবাস্টার কিন্তু আমার অনেকদিন কার ইচ্ছা একটি বায়োপিক করার ; কাকে নিয়ে করবো সেটাও ঠিক করা প্রোডিউসার ও রাজি কিন্তু মুশকিল একটাই যাকে নিয়ে করবো তার শেষ জীবনের পাঠ করার মতন সেইরকম দেখতে কাউকে পাচ্ছিনা….. অবশেষে আমার চিন্তা দূর হলো আপনাকে দেখে |”
“আমাকে দেখে মানে?” সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলো সৌমাল্য বাবু
” কারণ আপনাকে এই বয়েসে অনেকটাই ওনার মতন দেখতে ” বললেন সমরেশ বাবু
“এই উনি টা কে?? দয়া করে জানতে পারি ” বিরক্ত ভাবে প্রশ্ন করলেন সৌমাল্য বাবু |
” সেটা এখুন বলা যাবেনা ” বললেন সমরেশ বাবু
“বলা যাবেনা!! কেনো? ” অবাক হয়ে বললেন সৌমাল্য বাবু |
তারপর অনেক তর্ক বিতর্ক এবং বোঝানোর পর অবশেষে রাজি হলেন সৌমাল্য বাবু | খবর ছড়ালো সমরেশ মুখোপাধ্যায় নতুন ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় নবাগত ৫৮ বছর বয়েসী সৌমাল্য মল্লিক ; কিন্তু সৌমাল্য বাবু কার চরিত্র করছেন সেটা তিনি জানতে পারলেন না |
শুটিং শুরু হলো টানা ছয় মাস শুটিং হলো তারপর তিন মাস পর ছবির রিলিজ ; সমরেশ বাবু কথা অনুযায়ী ” সৌমাল্য বাবুর অভিনয়ের নাকি কোনো তুলনা হয়না….ইতিমধ্যে তিনি নাকি আরো ২টো সিনেমার ব্যাপারে কথা বলেছেন তার সাথে ” এমনটা নাকি বলেছেন খবরের কাগজওয়ালা দের সমরেশ বাবু |
হটাৎ কিছুদিন পর সৌমাল্য বাবু জানালেন এক দরকারি কাজ পড়াতে তাকে দশ দিনের জন্য ডালহৌসি যেতে হবে | আসলে প্রথম সিনেমায় অভিনয় করে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন সেগুলি কলকাতায় ব্যাংক এ জমা রেখে, বাকি সারা জীবনের জমানো টাকা ডালহৌসি থেকে নিয়ে আসতে যাচ্ছেন ; কারণ ডালহৌসির পাঠ শেষ করে তিনি ঠিক করেছেন বাকি জীবন কলকাতা এবং অভিনয় জগতেই কাটাবেন |
কিন্তু মানুষ ভাবে এক এবং লিখে রাখে অন্যকিছু ; পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেলেন সৌমাল্য মল্লিক | শোকের ছায়া নেমে এলো সমরেশ মুখোপাধ্যায় এর দলে কারণ তার নতুন ছবির শ্রেষ্ঠ অভিনেতা আর নেই , পেপার এ খবরে সব জায়গায় দেখানো হলো | কিছুদিন পর সিনেমার পোস্টার লঞ্চ হলো পোস্টার দেখে সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ সিনেমার নাম ‘ সৌমাল্য ‘ ; এই সৌমাল্য , সৌমাল্য মল্লিক নয় ইনি হলেন ইতিহাসের বিশ্ব বিখ্যাত চিত্র পরিচালক সৌমাল্য সেন , সমরেশ বাবু এতদিন সৌমাল্য সেন এর বায়োপিক বানানোর জন্য সৌমাল্য মল্লিক কে রাজি করিয়েছিলেন কারণ সৌমাল্য মল্লিক কে অনেকটাই সৌমাল্য সেন এর মতন দেখতে কিন্তু তিনি যে এই ভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে কে ভেবেছিলো | মারা যাওয়ার পর ও শ্রেষ্ঠ অভিনেতার প্রচুর অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন উনি….
সমরেশ বাবুর এখুন বয়েস পচাত্তর তিনি এখুন বিছানায় শজ্জাশাই….এই ঘটনার কথা তিনি তার নাতি কে শোনাছেন সব শুনে তার নাতি প্রশ্ন করলো ” আচ্ছা সৌমাল্য মল্লিক যে এত নাম এত টাকা পেয়েছিলো সে গুলো কোনো তাই টো সে ভোগ করতে ভোগ করতে পারলোনা… যা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলো সে গুলো কোনো তাই তো সে ভোগ করতে পারলোনা যা অ্যাওয়ার্ড ছিল সে গুলো তো সব শুনেছি সরকার এর কাছে আছে | কিন্তু ওই টাকা গুলো কি হলো? শুনেছি সেই সময় প্রচুর টাকা পেয়েছিলেন নবাগত হিসাবে এখুনো অব্দি কেও এত টাকা পাইনি?? “
” বিশ্বাস আর বিস্বাসঘাতকতা এরা যে কোন মানুষের সঙ্গে হাত মেলাবে বলা খুব মুশকিল… ” গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন সমরেশ বাবু |
” যার সম্মানের থেকে টাকার চাহিদা বেশি সে যা খুশি করতে পারে…… ” উত্তেজিত ভাবে বললেন সমরেশ বাবু |
” মানে… ঠিক বুঝলাম না ” বললেন সমরেশ বাবুর নাতি |
” সৌমাল্য মল্লিক কোনোদিন মরেইনি….সে তার সমস্ত টাকা নিয়ে ফাঁকি দিয়ে সকলকে বিদেশ পালিয়ে যাই…… “…” সব সত্য প্রকাশ করতে নেই দাদাভাই শুধু এই টুকু বলে রাখি সেদিন….কোনো ট্রেন এক্সিডেন্ট হয়নি… আর সিনেমা হল এ সৌমাল্য ও কোনোদিন মুক্তি পাইনি ” ||