হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে সংযুক্তা, মনটা ভালো খারাপ মিশ্রিত এক অদ্ভুত অনুভূতি, জীবন ভর মানুষ সঞ্চয় করা তার নেশা, মানুষ নিয়ে বাঁচতে ভালবাসে সে, তাদের সাথে মিশে, ছোটো ছোটো চরিত্র সৃষ্টি করে একটা ডাইরিতে জীবন্ত করে রেখেছে তাদের। কত দিন হলে গেলো আশপাশ টা কেমন শূন্য হোয়ে আছে, সব আছে তবুও ফাঁকা। খুব ইচ্ছা করছে আবার দেখতে একটা সুন্দর ভয়হীন পৃথিবী। তবুও এত খারাপের মধ্যেও ভালো থাকার কারণ খুঁজে পেয়েছিল, যখন নার্স প্রথম একটা ছোটো ফুটফুটে মুখ কে তার চোখের সামনে এনে বলেছিল, দেখো তোমার সন্তান। মা হয়েছো তুমি। ঠিক সেই সময়ে চোখের জল কে আটকাতে পারছিল না সংযুক্তা, চোখ দুটো বন্ধ করে ঈশ্বর কে প্রার্থনা জানিয়ে ছিল, কারুর জন্য না হক, তোমার পাঠানো নিষ্পাপ শিশুগুলোর জন্য, পৃথিবী আরো একবার সুন্দর করে দাও ভগবান।
(তিনদিন আগে) রাতে ঘুম আসছিলো না সংযুক্তার, মাঝরাতের দিকে একটু চোখটা জুড়িয়ে এসেছিল, একটা অস্বস্তিতে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যায়, এ সময় একটু ঘন ঘন বাথরুম পায়, ইউরিন চেপে রাখা যায় না। কতবার “প্রিয়” কে আর ডিস্টার্ব করা যায়? বেচারা ঘর বার সবটা একসাথে সামলায়। তাই ওকে আর ইচ্ছে হয়নি ডাকার, প্রিয়র বারণ সত্বেও একাই গিয়েছিল বাথরুমে। বসতে যাবে এমন সময় হঠাৎ একটা পেটে টান লাগে, একটা চরম অসহ্য যন্ত্রণায় মুখ থেকে শুধু মা টুকুই বার হয়েছিল বাদবাকিটা……. তারপর প্রিয় সামলে ছিল পুরোটা।
কিগো ? শরীর কেমন? প্রিয় সংযুক্তার মাথায় হাত রাখাতেই ওর চোখটা খুলে প্রিয় কে সামনে দেখতে পেয়ে ঘড়ির দিকে তাকায় সংযুক্তা ! ওমা ভিজিটিং আওয়ারস তো এখন চারটে বেজে গেছে কখন বুঝতেই পারিনি। কি ভাবছিলে? কি করে সবকিছু ম্যানেজ হবে তাইতো? চাপ নেই.. একজন ভদ্রমহিলাকে পেয়েছি, দেবু যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে উনি শিক্ষিত নার্সদের থেকে কোন অংশে কম নয়, বেশ এক্সপেরিয়েন্স বাচ্চা দেখার ব্যাপারে। উনি দিনের বেলা ম্যানেজ করে নেবেন আর আমরা দুজনে রাতটা, কি ভাবছো পারবোনা? আরে দেখোই না হাম হ্যায় তো কেয়া গাম হে। প্রিয় সংযুক্তার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চেপে ধরে রাখে। সংযুক্তা আস্তে আস্তে ওঠার চেষ্টা করতে করতে প্রিয় কে জিজ্ঞাসা করে এই লকডাউন অবস্থায় তোমার রোজ রাস্তা দিয়ে আসতে খুব অসুবিধা হয় তাই না? রোজ এই সময় আমার রাজপুত্র আমার জন্য অপেক্ষা করে আর আমি আসবো না তোমরা না কি !
তুমি ছেলের নাম রাজপুত্র রাখলে নাকি, আমি কিন্তু ওকে পপিন্স বলে ডাকবো, ওটা ওর ডাকনাম। সংযুক্ত গলায় উপর অভিমান ফুটে ওঠে শুধু তোমার রাজপুত্র অপেক্ষা করে বুঝি? তা না তো কি আমায় আজকে দেখে তুমি ভূত দেখার মতো চমকে উঠল! আমি এসে হাত সেনেটাইজ করে তোমার কাছে এসে দাঁড়ালাম আর তুমি বুঝতেই পারলে না।
নাগো চিন্তা হচ্ছে খুব। প্রথম মা হয়েছি কিচ্ছু জানি না কিভাবে একটা ছোট্ট শিশুর যত্ন নিতে হয় তার ওপর আবার এই ভাইরাস এর প্রকোপ। বুঝতে পারছি না কিভাবে ওকে দেখে রাখব। ঠিক পারব তো প্রিয় আমরা ওর যত্ন নিতে? এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে দম ছেড়েছিল সংযুক্ত। জানো সংযুক্তা যতটুকু আমি জানি তাতে বলতে পারি মেয়েদের কখনো মা হওয়া শেখাতে হয় না। তুমি খুব ভালো মা হয়ে উঠবে, হয়তো একটু সময় লাগবে এই আর কি! সংযুক্তার নাকটা চিপে ধরে প্রিয় খুনসুটি শুরু করেছিল,গল্প প্রেম করতে করতে বেল বেজে উঠলো, ঘড়ি ছটার কাটা ছুঁয়ে গেছে। প্রিয় নিজের ঠোঁটটা সংযুক্তার কপালে আলতো করে ছুয়ে দিয়ে আলবিদা বলে বেরিয়ে পড়ল।
প্রিয় রায়। একটি বেসরকারি কোম্পানির বেশ ভালো পোস্ট করা আদ্যোপান্ত ভদ্রলোক। শুধু সংযুক্তার প্রিয় ছোটবেলা থেকে অনাথ হওয়া ছেলেটা যে কিভাবে এত পজেটিভ মাইন্ডেড হতে পারে সেটা আজও ভাবায় সংযুক্তা কে। তার স্বামীজি পুরোপুরি একজন ডোমেস্টিক হাসবেন্ড, এক মামা প্রিয়র দায়িত্ব নিলেও ওর লাইফের জার্নিটা বোর্ডিং থেকে শুরু হয় তারপর চাকরি নিয়ে ব্যাঙ্গালোর ওখান থেকে কলকাতায় ট্রান্সফার তিন বছর পর। ওদের পরিচয়টা একটা কমন ফ্রেন্ডের মাধ্যমে নিজেদের গল্পটাকে প্রেমের কাহিনী করতে ওরা খুব বেশি সময় নেয়নি সেখান থেকে শুরু হল ওদের বিবাহ অভিযানের যাত্রা। প্রিয়র ভাগ্য থেকে ওর নিজের ভাগ্যের খুব একটা পার্থক্য নেই মা ছোটবেলায় ক্যান্সারে মারা যাওয়ায় বাবার কাছেই ছোট থেকে মানুষ রিটায়ার্ড অফিসার বাবা মেয়েকে প্রিয়র হাতে তুলে দিয়েছিল নিশ্চিন্তে । এখন উনি গ্যাংটক এ হোটেল ব্যবসায় খুব ব্যস্ত একজন মানুষ। বাচ্চাটা আসলেই বাবাকে তার কাছে নিয়ে আসার পরিকল্পনা ছিল কিন্তু লকডাউন সব গোলমাল করে দিল এখন আর কিছুই সম্ভব নয়।
দক্ষিণ কলকাতার একটি মধ্যবিত্ত পাড়ায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিল ওরা বিয়ের পর, ওখানে দুই থেকে তিন হওয়া ওদের। সকাল থেকে সংযুক্তার নাওয়া খাওয়ার সময় থাকে না, প্রিয় রীতিমতো বই উল্টে পাল্টে, নেট ঘেটে বাচ্চার দায়িত্ব পালনে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, দুপুরে আবার তাকে work-from-home করতে হয়। দুপুরে কোনরকম রান্নাবান্না করে রাখে, দুবেলা রান্না করার সময় কোথায়?
রাত দশটা, ঘরে হালকা আলো জ্বলছে। পাশে প্রিয় ঘুমিয়ে কাদা, রাতটা অন্তত প্রিয় কে জাগিয়ে রাখতে মন চায়না। ব্রেস্টফিড করাতে করাতে হঠাৎ মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল আজ যদি মা থাকতো তাহলে হয়তো আরো সুন্দর, আরো ভালো মা হয়ে উঠতে পারত ও পপিন্স এর। নিরাপত্তা সুরক্ষার ব্যাপারে ওর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে প্রিয় কে, কিন্তু বাচ্চার পরিচর্যা ও যত্ন ওর খেয়াল রাখা মায়ের থেকে তো মেয়েরা শেখে। গুগল সবজান্তা হলেও, মায়ের থেকে হয়তো কমই জানে। দুধ খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলেটা আস্তে করে তুলে ঢেকুরটা তুলিয়ে দিয়ে নিজের কোলে শুইয়ে দিল। ওর নিজের ছোট্ট নরম বিছানাতে শুতে চায় না, মায়ের কোলে পড়ে পড়ে অকাতরে ঘুমায়। খুব সতর্ক অনেক বার শোয়ানোর চেষ্টা করলেও লাভ কিছু হয়নি বরং কেঁদে অস্থির করে উঠেছে। খুব কষ্ট হয় রাতটাকে কাটাতে তবুও সব পারা যায় বুঝি একমাত্র সন্তানের জন্য, এটা সে হারে হারে বুঝে গেছে। বিছানা বালিশ নিয়ে বসে হেলান দিয়ে সে দিব্যি রাত কাটিয়ে দেয়, সবে চোখ টা একটু বন্ধ করেছে কি পড়েনি পাশের বাড়ির চিৎকারে ছেলেটা ভয় পেয়ে কেঁদে ওঠে। ওর কান্নার আওয়াজ এরকম হয়ে যায়। কোনরকমে ছেলেকে শান্ত করে ঘুম পারায়। প্রিয় উঠে গিয়ে গালমন্দ শুরু করে পাশের বাড়িতে। চার পাঁচ তলা উঁচু আবাসনগুলোর পাশে ভাঙাচোরা শ্যাওলাধরা জরাজীর্ণ একটা বাড়ি, পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া, সেখানেই সদস্য সংখ্যা তিন হলেও অশান্তি ত্রিশটা দিনেরই। প্রিয়র হাঁকডাকে লোকটা বের হয় না, ছেলেটা মদ খেয়ে কথা বলার অবস্থায় নেই, তবে বউটা বেরোয়, চুপ করে কথা গুলো শুনে ঘরে ঢুকে যায়। বড়ো রাগ হয় সংযুক্তার। এই অশান্তি এতদিন সহ্য করলেও আর মেনে নেয়া যায়না। ঘুম আসছিল না দুজনের গল্প করে ,গুগোল এ পড়াশোনা করতে করতে দু ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, আমি এখন আর ঘুমাবো না, পপিন্স একটু পরে উঠে যাবে, প্রায় দু’ঘণ্টা হয়ে গেল, খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে ওর।
পরের দিন ওই বাড়িতে কিছু লোক অবজেকশন করতে এলে সংযুক্ত জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বেশ গলা তাড়িয়ে কতগুলো কথা শুনিয়ে দিয়েছিল। না ঠিক হলে থানায় যাওয়ার থ্রেড ও দিয়েছিল। সেদিন রাতটা চুপচাপই কেটেছিল সবার।
আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব দের ফোন করা অল্প কথা বলে একটু রিলিফ পায় সংযুক্তা। সারাদিনে পপিন্স এর যত্ন নেওয়া, খাওয়ানো, ঘুমপাড়ানো, স্নান করানো, ওষুধ খাওয়ানো এসব করেই সারাদিন টা কেটে যায়, রাত্রে শরীরটা ভেঙেচুরে আসে, তবুও উপায় নেই। কাজের মহিলা টি লকডাউন না উঠলে আসতে পারবে না। ছেলেটা ঘুমাচ্ছে কোলেতে, মোবাইল প্যারেন্টিং নিয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ পি পি ডি সম্বন্ধে জানতে পারে সংযুক্তা।মা হওয়ার পর সবকিছু পাল্টে যাওয়া একাকীত্ব, নিরাশা, নিজের জন্য সময়ের অভাব, খাওয়া ঘুমের অনিয়ম, স্বচ্ছন্দ ত্যাগ করা, নিজের হবি বা পেশা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিরতি নেওয়া, ব্রেস্ট ফিডিং জন্য কোথাও না বের হতে পারা সব মিলিয়ে যে অবসাদ টা ধরে মায়েদের তারই পোশাকি নাম……….। যদিও এখন সারা পৃথিবীর শুদ্ধ ঘরবন্দি অবস্থাতেই আছে, তার সাথে খুব একটা পার্থক্য নেই এই মুহূর্তে পৃথিবীবাসীর। কানে ভেসে আসে পাশের বাড়ি থেকে আবার হালকা চেঁচামিচির শব্দ, বিষাক্ত লাগছে এ ফ্লাটটা কে। ছেলেটা দু-একবার নড়েচড়ে উঠছে, বড্ড সজাগ ঘুম, কান্না শুরু করতেই সংযুক্তা নিপিলটা মুখে ঢুকিয়ে দেয়।
সংযুক্তা রান্নাঘরে রান্না করছে। কোনরকম একটু হালকা ফুলকা রান্না করে নেয় সে কোন কোন দিন প্রিয় ও করে। পাশের বাড়ির ছেলেটা ওর মায়ের কাছে খাবার চায়, ওর মা একটু গলা তুলেই বলে, খাটের তলায় পান্তা রাখা আছে খেয়ে নে নুন লঙ্কা দিয়ে।
এটুকু পান্তায় কি হবে মা? তুমি খাবে না? আমি খেলে আর তোর খাওয়া জুটবে না। চুপচাপ খেয়ে নে।খুব মায়া হয় সংযুক্তার, কথাগুলো বড্ড কষ্ট দেয় তাকে, একটা মহামারী কি দিন দেখাতে পারে মানুষকে! জীবনে কোনদিনও কারো সঙ্গে ঝগড়া করেনি, মানুষকে আপন করে নেওয়া তার স্বভাবের সবচেয়ে বড় দিক। সেদিন যে কি হয়েছিল? ওদেরও সমস্যা থাকতে পারে। কেউ কি চায় নিজের ঘরে শুধু শুধু অশান্তি করতে? ভালো লাগছে না মনটা খারাপ হয়ে যাওয়াতে আর একটা পদ রান্না না করে গ্যাস টা অফ করে দিল।
আজ গলা দিয়ে ভাত নামবে না এটা সংযুক্তা আগেই জানত। কাতলা মাছের ঝোল দিয়ে ভাতটা খেতে খেতে প্রিয় বলেই ফেলল কি হয়েছে তোমার? খাও। খেতে বসে বড্ডো কষ্ট হয়, পাশের বাড়ির কথা ভেবে, “সামান্য রান্না করেছি জানো, নাহলে ওদের একটু দিতাম, ভাবছি কালকে কিছু টাকা দেবো ওদের। কটা দিন তো চলবে বলো!” কাদের টাকা দেবে? সবজি দিয়ে পাতলা মাছের ঝোলে মাখা ভাত টা মুখে পুরে জিজ্ঞাসা করে প্রিয়? নাম নিতে যাবে এমন সময় আবার চেঁচামেচি। ব্যাস পপিন্স এর কান্না থামায় কে! প্রিয় রেগে গিয়ে ওদের বাড়ি যেতে যাবে, কোনো রকমে সংযুক্তা আটকে নিলেও ওর আর সাহস হয়নি টাকা টা কাকে দিতে চায় সেটা বলার, প্রিয় কথায় কথায় ব্যাপারটা ভুলে যায়। সেই যে কেঁদে ওঠে পপিন্স, কিছু তেই তার কান্না থামানো যায় না, বুঝতে না পেরে অনেকক্ষণ পর প্রিয় ডাক্তারকে ফোন করে। এই সময় বাচ্চাদের টানা 2-3 ঘন্টা কান্না মানে, মনে হয় পেট ব্যাথা করছে ওর, ডক্টর ইনস্ট্রাকশন দেয়…. একটু ভালো করে অবজার্ভ করুন, ‘আমি একটা ওষুধ বলছি ওটা ইমিডিয়েট এনে ওকে 2-3 ফোঁটা খাইয়ে দেবেন। আশা করি ঠিক হয়ে যাবে, তবে চিন্তা করবেন না বাচ্চাদের এরকম সময়ে এটা খুব স্বাভাবিক।’
রাতে আজ প্রিয় অন্য ঘরে আছে, অফিসের কাজ করছে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম। অন্যদিন দুপুর থেকে বিকালের মধ্যে যা করার করে নেয়, আজ ছেলের পেট ব্যথার জন্য হয়ে ওঠেনি তার ওপর আবার আজ চাপ টা বড্ডো বেশি। খুব মায়া হয় মাঝে মাঝে প্রিয় কে দেখলে। এতদিন শুধু জানত “প্রিয় “তাকে খুব ভালবাসে, আজ প্রতিমুহূর্তে ভালবাসাটাকে অনুভব করতে পারে সংযুক্তা। সদ্য মা হওয়ার অক্লান্ত পরিশ্রম তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে পাশের বাড়ির ঘটনা টা। বারবার হাই উঠছে আজকে, চোখটা কিছুতেই খুলে রাখতে পারছে না, ভীষণ জ্বালা করছে। ব্রেস্ট ফিড করাতে করাতে ঢুলে পড়ছে বারবার। কোনো রকমে খাওয়া শেষ করিয়ে, পা দুটো ভাঁজ করে, ছেলেকে কোলে নিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কয়েক সেকেন্ডে, ঘড়িও দেখেনি কটা বাজে! গভীর ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যায় জানালা দিয়ে আসা পাশের বাড়ির চিৎকারে। ধড়পড় করে উঠে দেখে, পপিন্স কোলে নেই, বুক টা আর নেই ওর, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, ঘুম চোখে আবছা নিভু আলোয় সবটাই অস্পষ্ট, ফোনের লাইট টা জ্বালিয়ে দেখে তার বেখেয়ালি ঘুমের ঘোরে ছেলেটা কোল থেকে নিচে বিছানায় উল্টে পড়ে আছে, নাক মুখ টা দুমড়ে আছে, কতক্ষন এভাবে পড়ে আছে সে নিজেও জানে না। কোনো রকমে কোলে তুলে নিয়ে ওর বুকের কাছে নিজের কান টা রেখে শোনার চেষ্টা করছে ওর হৃদপিন্ডের শব্দ। গাল বেয়ে জল নামছে স্রোতের মতো, মুখ থেকে কথা সরছে না, প্রিয় কে যে ডাকবে সে ক্ষমতা ও হারিয়েছে। নাড়াচ্ছে ঝাকাচ্ছে, কাঁদানোর চেষ্টা করছে, ছেলে সাড়া দিচ্ছে না, ওকে কোলে নিয়ে ছুটে যেতে যায় প্রীয়র কাছে আর তখনই খুব জোরে কেঁদে ওঠে পপিন্স। ওঘর থেকে ছুটে আসে প্রিয়। ছেলের কান্না থামে মায়ের দুধ খেয়ে। তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও, আমি থাকছি ছেলের কাছে। না…..না…… বলে হাঁপিয়ে ওঠে ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে….. আমার কোন অসুবিধা নেই, আমি থাকতে পারবো। প্রিয়র খুব অবাক লাগে ছেলেকে নিয়ে এই ধরনের ব্যবহার কখনো করেনি এর আগে সংযুক্তা। একটা গ্লাসে জল নিয়ে এগিয়ে যায় তার স্ত্রীর দিকে। নাও খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও। প্রিয় মাথায় হাত বুলিয়ে বলে চোখ মুখের অবস্থাটা দেখেছো নিজের? তোমার চিন্তা নেই, আমি জেগে থাকবো। পপিন্স ওর বাবার কাছে খুব ভালো থাকবে, সংযুক্তা কথা বাড়াতে চায়নি, আস্তে করে দরজা খুলে চলে যায় অন্য ঘরে। দম বন্ধ করে অঝোরে কেদেই চলেছে, আর ঈশ্বরকে বারবার ধন্যবাদ দিচ্ছে। পাশের বাড়ির মানুষগুলোর কাছে ওর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ভাগ্যিস এই বাড়িটার পাশে ওরা থাকে না হলে যে কী হতো! তার কল্পনাও করতে ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। নিজেকে কষ্টি পাথরে যাচাই করার শিক্ষায় মানুষ সে, পরের দিকটাই বড়ো করে দেখে এসেছে সবসময়, আচ্ছা কোন মানুষ চায় নিজের সংসার এ শুধু শুধু অশান্তি করতে, সত্যি তো ওদের সমস্যা সে তো ওরাই জানে। এত সোজা কথা টা বুঝে উঠতে এত সময় অপচয় হলো করলো — স্বার্থপরতা ওর কাছে পাপের সমান। ভাবতেই লজ্জায় গুটিয়ে যাচ্ছে সংযুক্তা।
সকালে প্রিয় বাজার যাবে, কিছু নেই আজ ফ্রিজে। ছেলে ঘুমাচ্ছে, এই দিনের বেলা টুকু যা নিজে ঘুমায়। প্রিয় বাজারে বেরিয়ে যায় ব্যাগটা হাতে নিয়ে।প্রিয় কে কালকের ঘটনাটা বলা হয়নি, অযথা টেনশন করতো রাত্রে। ফিরুক বাজার থেকে, তারপর না হয় বলবে সবটা। কিন্তু ওদিক টা কি হবে? একটু কিছু রান্না করে দিয়ে আসবে ওদের বাড়ী? নাকি ওরা খারাপ ভাববে! দয়া করছি ভেবে ফিরিয়ে দেবে? মাথা কাজ করছে না কিছুতেই, তবে যাইহোক আমি যাবই। যাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তাদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে বাঁচতে পারব না। নিজের মনে কথা গুলো আওরে গেলো সংযুক্তা। এসব ভাবতে ভাবতেই পপিন্স উঠে পড়ে ঘুম থেকে, পরম যত্নে কোলের কাছে টেনে নিয়ে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে। দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দিয়ে গেছে প্রিয়, যদিও আরেকটা চাবি সবসময় ঘরেই থাকে, প্রিয় ঘরে এসে বাজারের ব্যাগ গুলো সামনে রেখে সোজা ওয়াশ রুমে ঢুকে যায়। সংযুক্তা তো অবাক এত বাজার ! খাব তো মাত্র দুজনে, ফ্রিজ এ এত ধরবে ? তুমি কি পুরো বাজারটাই তুলে আনলে নাকি? ছেলে কে রেখে ছুটে এসে বাজারের বহর দেখে সংযুক্তা মাথায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকে ! ওমা চাল এনেছ কেন ? তোমায় তো বলেছি আমার সমস্ত মুদিখানার বাজার ঘরে ভর্তি। প্রিয় এগিয়ে এসে বউকে জড়িয়ে ধরে, আমি জানি তুমি কালকে রাতে ঘুমাওনি। সংযুক্তা ছিটকে যেতে যায়, প্রিয়র কাছ থেকে………. মুখ নিচু করে নিয়ে চাপা স্বরে বলে, তোমায় বলিনি কারণ তুমি টেনশন করতে গো… জানো এরকম কোনদিনও হয়না আমার। প্রিয় বউকে আরো কষে ধরে। তুমি না বললেও আমি বুঝি, তোমায় বড্ড ভালবাসি সংযুক্তা, আর যারা ভালবাসে তাদের কাছে মনের কথা জেনে ফেলা টা কোনো ব্যাপারই না। আমারও রাতে ঘুম আসেনি তুমি চলে আসার পর, কানে আসছিল ওদের বাড়ির ঝগড়াঝাঁটি, পেরেলায়েজড বুড়ি ঠাকুমার ঔষধ ছিল না মনে হয়, রাতে বাড়াবাড়ি হয়েছিল খুব, অবশ্য চেষ্টা করছিল জানো, আমাদের ছেলেটার জন্য নিচু গলায় কথা বলার, সত্যি তো যাদের পেট দুবেলা উপোস করে থাকে, প্রয়োজনীয় ঔষধ টুকু থাকে না তাদের মুখ থেকে কি কবিতা এক্সপেক্ট করা উচিত আমাদের? আমার বউটা যে কি হারে মানুষ ভালোবাসে সেটা আমায় বলে দিতে হবে? ওদের জন্য তোমার ও খারাপ লেগেছে তাইনা? টাকা দেওয়ার কথা বলতে গিয়েও বলতে পারিনি দুপুরে আমায়…… সংযুক্তা অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে বরকে।রাতের ঘটনা টা আর চেপে রাখনি, কারণ ও জানে প্রিয় তাকে বুজবে না এটা অসম্ভব। প্রিয় ব্যাগ দুটো এগিয়ে দেয়, যাও ওদের বাড়িতে দিয়ে এসো, চাল, ডাল, সবজি, ডিম, মসলা, তেল, আটা, মোটামুটি যা লাগে নিয়ে এসেছি। আমি পপিন্স এর কাছে আছি। ও হ্যাঁ আসার সময় প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে এসো তো ঠাকুমার। বলো লকডাউন চলাকালীন এসব নিয়ে একদম চিন্তা না করতে। আমরা পাশে আছি। সংযুক্তা চোখ মুখ মুছে, ড্রেস টা চেঞ্জ করতে ঘরে ঢুকলো।
আরও পড়ুন – ২০২১ এর চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ এর সময় ও কোথায় দেখা যাবে জেনে নিন
পাশের বাড়ির মানুষ গুলো এত ভালো, কোনো দিনও বোঝে নি তো, দুপুর বেলা শুয়ে শুয়ে বর কে আঁকড়ে ধরে গল্প করছিল সংযুক্তা। ও যেতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে কিসে বসতে দেবে বুঝতে পারছিল না, অনেক গল্প করল, বারবার ক্ষমা চাইছিল খুব করে, ভদ্রমহিলা বলছিল জানো, আজকে নাকি ওরা চাল ডাল গম পাবে সরকার থেকে। অতগুলো খাবার দেখে চোখ টা কান্নায় চিকচিক করছিল ওই বুড়ি মানুষটার। খুব আশির্বাদ করলো আমাদের আর পপিন্স কে। ওদের খুব দেখার ইচ্ছা ছেলে কে কিন্তু সাহস করে আসতে পারিনি। আসার সময় হাত ধরে ঠাকুমার কি কান্না! বলে- অনেক করেছো মাগো আমাদের জন্য তোমরা! এত কিছু লাগবেনা আমাদের, যদি পারো তো আমার নাতি টা কে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দাও। ছেলে টাও বলল জানো, যেকোনো একটা কাজ হলেই হলো শুধু আমি উপার্জন করতে চাই একটু দেখুন না দাদা কে বলে। লকডাউন টা উঠে গেলে হয়ে যাবে কাজের ব্যবস্থা, বলে দিও। ওষুধগুলো কাল সকালে নিয়ে আসবো। অফিস থেকে ফোন আসে…… প্রিয় উঠে যায়……. এবার শুরু হবে ওর ওয়ার্ক ফ্রম হোম। লকডাউন টা মানুষকে অনেক কিছু চিনতে শেখালো নতুন করে, স্পর্শ হীন ভাবে এখন মানুষ মানুষকে ছুয়ে আছে, করোনা’ র বিরুদ্ধে জেতার এটার চেয়ে বড় অস্ত্র আর কি বা হতে পারে ?? মানুষ আর মানবিকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে, না আর দেরি নেই নতুন ভোরের, যেখানে সাম্প্রদায়িকতা নয় সম্প্রীতি নিয়ে মানুষ বাঁচবে। লকডাউন কে সফল করতে পারলেই, আবার তৈরি হবে আমদের সুস্থ সুন্দর পৃথিবী। এসব ভাবতে ভাবতে ছেলেকে বুকের কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে পরলো সংযুক্তা।