Thursday, June 1, 2023
Homeগল্প ও উপন্যাসপাহাড়ের কোলে ছবির মতো ছোট্ট গ্রাম লাচুং

পাহাড়ের কোলে ছবির মতো ছোট্ট গ্রাম লাচুং

লাচুং — বড় বড় পাহাড়ের মধ্যে ছোট্ট একটি গ্রাম। উত্তর সিকিমের ৯ হাজার ৬০০ ফুট উঁচুতে এর অবস্থান। যারা নির্জন জায়গা ভালোবাসেন, তাদের কয়েকদিনের ঠিকানা হতে পারে লাচুং। যারা প্রিয়জনকে নিয়ে চা হাতে গল্পের আসর জমাতে চান, তারা কোনো কিছু না ভেবেই ঘুরে আসতে পারেন। ভালো লাগবেই! দেখেই মনে হবে গাছ ছেয়ে আছে ছোট-ছোট সবুজ কুঁড়িতে। যেন সবুজের কোলে ছবির মতো ভেসে আছে পাহাড়ি গ্রামটি।

চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম পুরো লাচুং। পৃথিবীর সব সবুজ রঙ বুঝি এখানে এসে জড়ো হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল কেউ যেন আপন খেয়ালে ক্যানভাসে এঁকে দিয়ে গেছে এই সবুজ চাদরে ঢাকা উপত্যকা। চারিদিকে সবুজ কর্ণিফার– ঘেরা পাহাড়। তার ওপরে ছোট-ছোট কাঠের বাড়ি এদিক-ওদিক ছড়ানো। বহু দূরে অনেক উঁচুতে সাদা তুষারে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া। দিনের শেষ আলো ছড়িয়ে পড়ছে ওর গায়ে। চিকচিক করে উঠছে। শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা নামছে পাহাড়ের কোলে।

আপনি যদি ভ্রমণপিপাসু হয়ে থাকেন তাহলে হয়তো জানেন, কিছু কিছু শহরের থাকে যার নিজস্ব প্রাণ থাকে। চলার ছন্দ থাকে। লাচুংকে দেখে আমার মনে হচ্ছিল সে যেন একজন কিশোরী; হাসছে, খেলছে, ছুটে চলছে। আর পথের মাঝে মাঝে থেমে শ্বাস নিচ্ছে- দু’চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে দু’পাশের দৃশ্যকে। কোনো কিছুর তাড়া নেই একেবারেই। এমন জায়গা ঘুরে মুগ্ধ না হয়ে উপায় আছে?

লাচুং শব্দের অর্থ ‘ছোট গমনোপযোগী অঞ্চল’। এখানে একটি মনাস্ট্রিও আছে। কয়েকজন লামা থাকেন এখানে। লাচুং-এ আছে একটি কার্পেট বুনন কেন্দ্র। সারা বিশ্বের পর্যটকরা অক্টোবর থেকে মে পর্যন্ত এখানে ঘুরতে আসেন। এই সময়টুকুই লাচুং ভ্রমণের পিক টাইম। মূলত ইয়ামথাং ভ্যালি, লাচুং মনাস্টেরি দেখার পথেই তারা লাচুং আসেন। এখানকার অধিকাংশ অধিবাসীই লেপচা এবং তিব্বতীয়।

পরদিন যখন ঘুম থেকে উঠলাম। তখনো পুরো শহর ঘুমিয়ে। পূর্ব দিক বলে সূর্য ওঠে খুব তাড়াতাড়ি। আমরা যখন বেরোলাম তখন সকাল ৮টা ৩০ মিনিট। রাতে বৃষ্টি হয়েছে এখানে। এখন আকাশ সম্পূর্ণ পরিষ্কার। শুধু গাছের পাতায় বিন্দু-বিন্দু শিশির। আমাদের হোটেল একটু নিচে। সামনে উঁচু পাথুরে রাস্তা বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেছে। রাস্তার দু’ধারে সরু নালা দিয়ে পরিষ্কার জল কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে। দেখলাম ছোট-ছোট ট্রাউট মাছ সেখানে খেলে বেড়াচ্ছে।

আমরা এখন ৯ হাজার ফুট ওপরে। এখন চলেছি ৪৬ কিলোমিটার দূরে ১৫ হাজার ৩০০ ফুট উপরে ইয়ামসামডাং-জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। আসলে সাধারণ পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে এই ইয়ামসামডাং পড়ে না। তাই আগেই গ্যাংটক থেকে আলাদা অনুমতি নেয়া ছিল। লাচুং থেকে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ। চলেই যাচ্ছিলাম সোজা ওপরের দিকে। পাকদণ্ডি বেয়ে। চড়াই-উৎরাই ভেঙ্গে, এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। পথের দু’ধারে যে কত রকমের রঙিন পাহাড়ি ফুল তার কোনো হিসেব নেই।

দুপুর ১২টা। জিরো পয়েন্টে পৌঁছলাম। পথটার শেষ এখানেই! আর কোনো রাস্তা নেই, তবে সামনে একটা উঁচু পাহাড়। স্বচ্ছ নীল আকাশ পাহাড়ের সীমানা ছুঁয়েছে। তার ওপারেই ‘চায়না’। এখানে কোনো জনবসতি নেই। যেদিকেই তাকাচ্ছি শুধুই সাদা বরফ। সঙ্গে শরির-হিম করা ঠাণ্ডা হাওয়া। কয়েক জায়গায় বরফ গলে-গলে সরু জলের ধারা তৈরি হয়েছে।

বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে পাথরের উপরে গিয়ে বসলাম কিছুক্ষণ। হঠাৎ মনে হল পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেন অন্য আরেক পৃথিবীতে এসে পড়েছি। বাতাসের শব্দ টুকু ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সমস্ত লোকচক্ষুর আড়ালে প্রকৃতি যে এত উদার ভাবে এত সৌন্দর্য ছড়িয়ে রাখতে পারে; তা সত্যি অবিশ্বাস্য! লাচুংকে যদি ছোট্ট কিশোরী মনে করি; তবে ইয়ামসামডাং যেন তার কঠিন প্রেমিক।

সব সৌন্দর্যই কি আর নদীর মত নরম হতে পারে? কিছু কিছু সৌন্দর্য থাকে যা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ইয়ামসামডাং সেই সৌন্দর্যের নাম। ১৮৫৫ সালে বিখ্যাত পরিব্রাজক জোসেফ ডালটন হুকার দ্য হিমালয়ান জার্নালে লাচুংকে সিকিমের ‘ছবির মতো গ্রাম’ হিসেবে আখ্যা দেন। কেন দিয়েছে সেখানে গেলেই অনুভব করা যায়!

সুদীপা দাস

follow khobor dobor on google news
Follow Us on Google News

আরও পড়ুন –

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments