‘ওঁ খড়্গং চক্রগদেষুচাপপরিঘান শূলং ভুসূণ্ডিং শিরঃ| শঙ্খং সন্দধতীং করৈস্ত্রিনয়নাং সর্বাঙ্গভূষাবৃতাম্ || নীলাশ্মদ্যুতিমাস্যপাদদশকাং সেবে মহাকালিকাম্ | যামস্তৌচ্ছয়িতে হরৌ কমলজো হন্তুং মধুং কৈটভম্ ||’ —-মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর প্রথম চরিত্র শ্রী শ্রী মহাকালীর ধ্যানমন্ত্রে পাওয়া যায়।
কালী’ শব্দটি ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। এই শব্দের অর্থ ‘কৃষ্ণ’ (কালো) বা ‘ঘোর বর্ণ’। ‘কাল’ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে: ‘নির্ধারিত সময়’ ও ‘মৃত্যু’। কিন্তু দেবী প্রসঙ্গে এই শব্দের মানে “সময়ের থেকে উচ্চতর”। মা কালী বা কালিকা একজন হিন্দু দেবী। যাঁর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। প্রধানত শাক্ত ধর্মাবলম্বীরা কালীর পূজা করেন। হিন্দু শাস্ত্র মতে, শক্তির প্রতীক মায়ের এই রূপ। তন্ত্রশাস্ত্রের মতে, দেবী কালী দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত , তন্ত্রমতে পূজিত প্রধান দশ জন দেবীর মধ্যে মা কালী প্রথম দেবী। শাক্তরা কালীকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির কারণ মনে করে। তাদের মতে, কালী সেই আদি শক্তিরই মূর্ত রূপ। এই কথা সকলেরই জানা যে, মা কালীর সৃষ্টি স্বয়ং মা দুর্গার থেকেই। মূলত, হিন্দুধর্মে মহাশক্তির যে পূজা হয়, তা মাতৃকা নামে পরিচিত। এই মাতৃকা নামক মহাশক্তির সাতটি রূপ। তাঁরা হলেন- ব্রহ্মাণী, বৈষ্ণবী, মাহেশ্বরী, ইন্দ্রাণী, কৌমারী, বারাহি এবং চামুণ্ডা। এই চামুণ্ডাই হলেন, দেবীর ভয়ঙ্কর রূপ। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবী কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়। কিন্তু আজকের এই কালী বা শ্যামা মূর্তি কিন্তু খুব প্রাচীন নয়। কথিত আছে, ষোড়শ শতকের তন্ত্র সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশই প্রথম কালীর রূপ কল্পনা করেছিলেন। তার আগে দেবী পূজিতা হতেন ‘যন্ত্রে’। এছাড়াও গুহ্য মূর্তি শবশিবা বা অন্য কল্পে দেবী পূজিতা হতেন। দেবীর সেই রূপ গৃহী ভক্তদের উপযোগী নয় ভেবে কৃষ্ণানন্দ সেই রূপে বদল আনেন।
মা কালীর নামের উৎস নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। যেমন- মা কৃষ্ণবর্ণ বলেই তিনি কালী বা কালিকা নামে পরিচিত। আবার ঊনবিংশ শতাব্দীর সংস্কৃত ভাষার অভিধান শব্দকল্পদ্রুমে বলা আছে, শিবই কাল বা মহাকাল। তাঁর পত্নীই কালী। ইনি মহাদেবের শরীরে প্রবেশ করে তাঁর কণ্ঠের বিষে কৃষ্ণবর্ণা হয়েছেন। পাণিনি অনুযায়ী, কালী’ শব্দটি ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ, যার অর্থ “কৃষ্ণ, ঘোর বর্ণ”। মহাভারত অনুসারে, কালী দুর্গার একটি রূপ। আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালী একজন দানবীর নাম। ‘কাল’, যার অর্থ ‘নির্ধারিত সময়’, তা প্রসঙ্গক্রমে ‘মৃত্যু’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এর সমোচ্চারিত শব্দ ‘কালো’র সঙ্গে এর কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। কিন্তু লৌকিক ব্যুৎপত্তির দৌলতে এরা পরস্পর সংযুক্ত হয়ে গেছে। মহাভারত-এ এক দেবীর উল্লেখ আছে যিনি হত যোদ্ধা ও পশুদের আত্মাকে বহন করেন। তাঁর নাম কালরাত্রি বা কালী। সংস্কৃত সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক টমাস কবার্নের মতে, এই শব্দটি নাম হিসাবে ব্যবহার করা হতে পারে আবার ‘কৃষ্ণবর্ণা’ বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে।
দেবীপুরাণ, দেবীমাহাত্ম্য, কালিকাপুরাণ ও তন্ত্র গ্রন্থগুলিতে কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। সাধারণভাবে দেবী চতুর্ভুজা, তাঁর মূর্তিতে চারটি হাতে খড়্গ, অসুরের ছিন্নমুণ্ড, বর ও অভয়মুদ্রা, গলায় মুণ্ডমালা, লোলজ্বিহা, বক্রনয়না, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ (মতান্তরে নীল), এলোকেশ দেখা যায়। মহাদেবের বুকের উপর দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। দেবী কালীর মূলত আটটি রূপের উপাসনা আমরা করে থাকি। যা তোড়ল তন্ত্র মতে, অষ্টধা বা অষ্টবিধ নামে পরিচিত।তাঁর আটটি রূপ হল , যথা – দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালী, শ্মশানকালী ও শ্রীকালী। মহাকাল সংহিতা অনুসারে আবার কালী নববিধা , যথা – দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, কালকালী, গুহ্যকালী, কামকলাকালী, ধণকালিকা, সিদ্ধিকালী, সিদ্ধিকালী, চণ্ডিকালিকা। ব্রহ্মযামল মতে, কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কালীর বিভিন্ন রূপভেদ আছে। যেমন – দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি। আবার বিভিন্ন মন্দিরে “ব্রহ্মময়ী”, “ভবতারিণী”, “আনন্দময়ী”, “করুণাময়ী” ইত্যাদি নামে কালীপ্রতিমা প্রতিষ্ঠা ও পূজা করা হয়।
রূপভেদ
দক্ষিণাকালী:
দেবীর সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ও জাগ্রত রূপমূর্তি দক্ষিণাকালী। তার এই নামের ব্যাখ্যায় শাস্ত্রে বলা হয়েছে, দক্ষিণ দিকের অধিপতি যম যে কালীর ভয়ে পলায়ন করেন, তার নাম দক্ষিণাকালী। বঙ্গদেশে সবথেকে বেশী আরাধনা করা হয় দক্ষিণাকালীর। ইনি প্রচলিত ভাষায় শ্যামাকালী নামে আখ্যাতা। দক্ষিণাকালী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তাঁর বামকরযুগলে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ; দক্ষিণকরযুলে বর ও অভয় মুদ্রা। তাঁর গাত্রবর্ণ মহামেঘের ন্যায়; তিনি দিগম্বরী। তাঁর গলায় ঝোলে মুন্ডমালার হার, তিনিই মুন্ডুমালা বিভূষিতা; কর্ণে দুই ভয়ানক শবরূপী কর্ণাবতংস; কটিদেশে নরহস্তের কটিবাস। তাঁর দন্ত ভয়ানক; তাঁর স্তনযুগল উন্নত; তিনি ত্রিনয়নী এবং মহাদেব শিবের বুকে দণ্ডায়মান। তাঁর দক্ষিণপদ শিবের বক্ষে স্থাপিত। তিনি মহাভীমা, হাস্যযুক্তা ও মুহুর্মুহু রক্তপানকারিনী। তাঁর পূজা করলে ত্রিবর্ণা তো বটেই সর্বোপরি সর্বশ্রেষ্ঠ ফলও দক্ষিণাস্বরূপ পাওয়া যায়।
সিদ্ধকালী:
সিদ্ধকালী কালীর একটি অখ্যাত রূপ। গৃহস্থের বাড়িতে সিদ্ধকালীর পূজা হয় না। তিনি মূলত সিদ্ধ সাধকদের ধ্যান আরাধ্যা। কালীতন্ত্রে দেবীকে দ্বিভুজা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। অন্যত্র তিনি ব্রহ্মরূপা ভুবনেশ্বরী। তাঁর মূর্তির দক্ষিণহস্তে ধৃত খড়্গের আঘাতে চন্দ্রমণ্ডল থেকে অমৃত রস নিঃসৃত হয়, সেই অমৃত রস বামহস্তের কপালপাত্রে ধারণ করে পরমানন্দে পান করেন দেবী। তিনি সালংকারা। তাঁর দক্ষিণপদ শিবের বুকে ও বামপদ শিবের উরুদ্বয়ের মধ্যস্থলে সংস্থাপিত। এই দেবী রক্ত নয়, বরং অমৃত পানে সন্তুষ্ট থাকেন।
গুহ্যকালী:
গুহ্যকালী বা আকালীর রূপ ভয়ংকর। গুহ্যকালী বা আকালীর রূপ গৃহস্থের কাছে অপ্রকাশ্য। তিনি সাধকদের আরাধ্য। তাঁর রূপকল্প ভয়ংকর: গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়; তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা; গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা; কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র; স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত; মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র; কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার; হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা; বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ; বামে বৎসরূপী শিব; তিনি নবরত্নভূষিতা; নারদাদিঋষিগণ শিবমোহিনী গুহ্যকালীর সেবা করেন; তিনি অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফলপ্রদায়িনী। গুহ্যকালী নিয়মিত শবমাংস ভক্ষণে অভ্যস্তা।মহাকাল সংহিতা মতে, নববিধা কালীর মধ্যে গুহ্যকালীই সর্বপ্রধানা। তাঁর মন্ত্র বহু – প্রায় আঠারো প্রকারের।
মহাকালী:
তন্ত্রসার গ্রন্থমতে, মহাকালী পঞ্চবক্ত্রা ও পঞ্চদশনয়না। তবে শ্রীশ্রীচণ্ডী-তে তাকে আদ্যাশক্তি, দশবক্ত্রা, দশভূজা, দশপাদা ও ত্রিংশল্লোচনা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। তার দশ হাতে রয়েছে যথাক্রমে খড়্গ, চক্র, গদা, ধনুক, বাণ, পরিঘ, শূল, ভূসুণ্ডি, নরমুণ্ড ও শঙ্খ। ইনিও ভৈরবী তবে গুহ্যকালীর সঙ্গে এঁর পার্থক্য রয়েছে। ইনি সাধনপর্বে ভক্তকে উৎকট ভীতি প্রদর্শন করলেও অন্তে তাকে রূপ, সৌভাগ্য, কান্তি ও শ্রী প্রদান করেন।
ভদ্রকালী:
ভদ্রকালী নামের অর্থ যিনি মরণকালে জীবের মঙ্গল বিধান করেন, তিনিই ভদ্রকালী। ভদ্রকালী নামের ভদ্র শব্দের অর্থ কল্যাণ এবং কাল শব্দের অর্থ শেষ সময়। অনেক ক্ষেত্রে দুর্গা ও সরস্বতীর ওপর নাম হিসেবেই এই নামটি ব্যবহৃত হয়। কালিকাপুরাণ মতে, ভদ্রকালীর গাত্রবর্ণ অতসীপুষ্পের ন্যায়, মাথায় জটাজুট, ললাটে অর্ধচন্দ্র ও গলদেশে কণ্ঠহার। তন্ত্রমতে অবশ্য তিনি মসীর ন্যায় কৃষ্ণবর্ণা, কোটরাক্ষী, সর্বদা ক্ষুধিতা, মুক্তকেশী; তিনি জগৎকে গ্রাস করছেন; তার হাতে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা ও পাশযুগ্ম। গ্রামবাংলায় অনেক স্থলে ভদ্রকালীর বিগ্রহ নিষ্ঠাসহকারে পূজিত হয়। সকল ‘অবিদ্যা’-র দেবী তিনি।গ্রামবাংলায় অনেক স্থলে ভদ্রকালীর বিগ্রহ নিষ্ঠাসহকারে পূজিত হয়। এই দেবীরও একাধিক মন্ত্র রয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ চতুর্দশাক্ষর মন্ত্রটি হল – ‘হৌঁ কালি মহাকালী কিলি কিলি ফট স্বাহা’।
চামুণ্ডাকালী বা চামুণ্ডা:
চামুণ্ডাকালী বা চামুণ্ডা ভক্ত ও সাধকদের কাছে কালীর একটি প্রসিদ্ধ রূপ। দেবীভাগবত পুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে, চণ্ড ও মুণ্ড নামক দুই অসুর বধের নিমিত্ত কৌশীকিরর(পার্বতী) ভ্রুকুটিকুটিল ললাট থেকে চামুণ্ডার উৎপত্তি। অস্থিচর্মসার বিকটদন্ত দেবীর হস্তে অস্ত্র, দণ্ড ও চন্দ্রহাস, পরিধানে ব্যাঘ্রচর্ম। দুর্গাপুজোর মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে আয়োজিত সন্ধিপুজোর সময় দেবী চামুণ্ডার পুজো হয়। অগ্নিপুরাণ-এ আট প্রকার চামুণ্ডার কথা বলা হয়েছে। তাঁর মন্ত্রও অনেক। পূজক অশুভ শত্রুবিনাশের জন্য শক্তি প্রার্থনা করে তাঁর পূজা করেন।
শ্মশানকালী:
গৃহস্থ বাড়িতে এই দেবীর পুজো হয় না। প্রাচীনকালে ডাকাতরা এই দেবীর আরাধনা করতো।কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “দেবী চৌধুরানী” উপন্যাসে এই দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এই দেবীকে শ্মশানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনে করা হয়। কালীর “শ্মশানকালী” রূপটির পূজা সাধারণত শ্মশানঘাটে হয়ে থাকে।ন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ রচিত বৃহৎ তন্ত্রসার অনুসারে এই দেবীর ধ্যানসম্মত মূর্তিটি নিম্নরূপ:
শ্মশানকালী দেবীর গায়ের রং কাজলের মতো কালো। তিনি সর্বদা বাস করেন। তাঁর চোখদুটি রক্তপিঙ্গল বর্ণের। চুলগুলি আলুলায়িত, দেহটি শুকনো ও ভয়ংকর, বাঁ-হাতে মদ ও মাংসে ভরা পানপাত্র, ডান হাতে সদ্য কাটা মানুষের মাথা। দেবী হাস্যমুখে আমমাংস খাচ্ছেন। তাঁর গায়ে নানারকম অলংকার থাকলেও, তিনি উলঙ্গ এবং মদ্যপান করে উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন। শ্মশানকালীর আরেকটি রূপে তাঁর বাঁ-পাটি শিবের বুকে স্থাপিত এবং ডান হাতে ধরা খড়্গ। এই রূপটিও ভয়ংকর রূপ। তন্ত্রসাধকেরা মনে করেন, শ্মশানে শ্মশানকালীর পূজা করলে শীঘ্র সিদ্ধ হওয়া যায়। রামকৃষ্ণ পরমহংসের স্ত্রী সারদা দেবী দক্ষিণেশ্বরে শ্মশানকালীর পূজা করেছিলেন।গৃহস্থবাড়িতে বা পাড়ায় সর্বজনীনভাবে শ্মশানকালীর পূজা হয় না। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন, শ্মশানকালীর ছবিও গৃহস্থের বাড়িতে রাখা উচিত নয়।
সেকালে কাপালিকরা শবসাধনার সময় কালীর শ্মশানকালী রূপটির ধ্যান করতেন। এমনকি ডাকাতেরা ডাকাতি করতে যাবার আগে শ্মশানঘাটে নরবলি দিয়ে শ্মশানকালীর পূজা করতেন। ডাকাতদের পূজিতা বলেই এই কালীকে ডাকাতকালীও বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতকালীর পূজা হয়। পশ্চিমবঙ্গের অনেক প্রাচীন শ্মশানঘাটে এখন শ্মশানকালীর পূজা হয়।
শ্রীকালী:
শ্রীকালী গুণ ও কর্ম অনুসারে দেবী কালীর আরেক রূপ। মনে করা হয়, শ্রীকালী দারুক নামক অসুর নাশ করেন। ইনি মহাদেবের শরীরে প্রবেশ করে তাঁর কণ্ঠের বিষে কৃষ্ণবর্ণা হয়েছেন এবং পরবর্তীকালে মহাদেব শিশুরূপে তাঁর স্তন্যপান করেন। শিবের মতো ইনিও ত্রিশূলধারিনী ও সর্পযুক্তা।
আদ্যাকালী:
মহানির্বাণ তন্ত্রে এই দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। কলকাতার আদ্যাপীঠের কালী ও এই দেবীর রূপ কিন্তু এক নয় এবং আদ্যাস্ত্রোত্রের দেবীও ইনি নন। আদ্যাকালীর রং মেঘের মতো ঘন নীল, কপালে চন্দ্ররেখা,ত্রিনেত্রা,রক্তবস্ত্র পরিধানে থাকে। প্রস্ফুটিত রক্তপদ্মে দেবী আসীনা হয়ে,মাধ্বীক পুষ্পের মিষ্টি সুধা পান করে সম্মুখে নৃত্যরত মহাকালের নৃত্য দর্শন করে আনন্দিতা তিনি।
রক্ষাকালী:
রক্ষাকালীকে দক্ষিণাকালীরই একটি নাগরিক রূপ হিসেবে ধরা হয়। প্রাচীন কালে নগর বা লোকালয়ের রক্ষার জন্য এই দেবীর পুজো করা হতো। দেবীর পূজা মন্ত্রও ভিন্ন। স্থানভেদে রক্ষাকালীর বাহন সিংহ। মহাকাল সংহিতায় দেবী কালিকার নয়টি রূপের উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার তন্ত্রালোক ও তন্ত্রসার গ্রন্থে দেবীর ১৩টি রূপের সন্ধান মেলে। সৃষ্টিকালী, স্থিতিকালী, সংহারকালী, রক্তকালী, যমকালী, মৃত্যুকালী, রুদ্রকালী, পরমার্ককালী, মার্তণ্ডকালী, কালাগ্নি রুদ্রকালী, মহাকালী, ঘোরচণ্ডকালী, মহাভৈরবকালী। এছাড়াও আছেন, ডম্বরকালী, ইন্দিবরকালী, বামাকালী, হংসকালী, শ্যামাকালী, পার্বতীকালী, রটন্তীকালী, ফলহারিণী কালী, নিত্যকালী, ঈশানকালী, জীবকালী, বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী ইত্যাদি। ‘কাল’ অর্থাৎ সময়ের জন্মদাত্রী পালনকর্ত্রী এবং প্রলয়কারিণী বলেই দেবীর নাম কালী। তিনি শিব বা শব, অর্থাৎ মৃত্যুর ওপর দাঁড়িয়ে জীবনের প্রতীক। তিনিই চেতনার প্রকাশ।
গৃহে বা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত কালীপ্রতিমার নিত্যপূজা হয়। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ তিথিতেও কালীপূজার বিধান আছে। আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপূজা, মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে রটন্তী কালীপূজা এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে ফলহারিনী কালীপূজা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও শনি ও মঙ্গলবারে, অন্যান্য অমাবস্যায় বা বিশেষ কোনো কামনাপূরণের উদ্দেশ্যেও কালীর পূজা করা হয়।