মহাদেবের ত্রিনয়ন সৃষ্টির রহস্য : পৌরাণিক কাহিনী ও দিব্যদর্শনের তাৎপর্য

lord-shiva

সনাতন ধর্মের সর্বশক্তিমান,সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের দেবতা হলেন দেবাদিদেব মহাদেব। তবে মহাদেব একটি নামে পরিচিত নন। নীলকন্ঠ, শম্ভু, মহেশ্বর সহ বহু নামে পরিচিত সর্বশক্তিমান শিব। সারাবছর ধরে বিশেষত শিবরাত্রি ও নীলপুজোতে বহু ভক্ত নিজ মনস্কামনা নিয়ে উপবাস করে বাবার বিমূর্ত প্রতীক শিবলিঙ্গে জল ঢালেন এবং নিজেদের মনস্কামনা জানান মহাদেবকে। একাধিক রূপে পূজিত হন মহাদেব। তবে সর্বাধিক প্রচলিত রূপ- মাথায় জটা, হাতে-গলায় রুদ্রাক্ষ এবং গলায় জড়িয়ে থাকা সাপ। আর কপালে ত্রিনয়ন। মহেশ্বর যেমন শান্ত তেমনি প্রলয়ঙ্কর, তাঁর রুদ্ররূপে কেঁপে ওঠে জগত। মহেশ্বরের ত্রিনয়নে ভাসে গোটা জগতের কার্যকলাপ। তবে মহাদেব সবসময় নিজ ত্রিনয়ন খোলেন না। শাস্ত্র অনুসারে মাত্র কয়েকবার নিজের তৃতীয় চক্ষু খুলেছিলেন মহাদেব। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই ত্রিনয়ন সৃষ্টি কিভাবে?কখন এবং কেন মহাদেব তাঁর ত্রিনয়ন খুলেছিলেন?এবং কি এই মহাদেবের ত্রিনয়নের (Third Eye of Shiva)রহস্য।

শিবের ত্রিনয়ন (Third Eye of Shiva) সৃষ্টি :

কথিত আছে, মহাদেবের ত্রিনয়ন আসলে তাঁর দিব্য দৃষ্টি। এই দিব্য দৃষ্টি থেকে কোনও কিছুই বাদ পড়ে না। ভোলানাথের তৃতীয় নয়নকে জ্ঞানচক্ষুও বলা হয়। এতে আত্মজ্ঞানআত্মজ্ঞানপ্রাপ্ত হয়। তিন লোকের গতিবিধির উপর নজর রাখতে পারেন তিনি। ত্রিনয়ন দিয়ে সমস্ত বিষয় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন গৌরীশ। ত্রিনয়নকে তাঁর শক্তিকেন্দ্রও বলা হয় । এমনও মনে করা হয়, শিব তৃতীয় চোখ খুললেই ভষ্মীভূত হয়ে যাবে গোটা বিশ্ব। পুরান মতে মহেশ্বরের তৃতীয় চোখের সৃষ্টি নিয়ে নানা কাহিনী রচিত রয়েছে।কোথাও বলা হয়েছে কামদেবকে ভষ্ম করতে মহাদেবের তৃতীয় চোখের সৃষ্টি হয়। আবার কোথাও বর্ণিত রয়েছে মহাজাগতিক পৃথিবীকে অন্ধকারাচ্ছন্ন থেকে রক্ষা করতে মহাদেবের ত্রিনয়নের সৃষ্টি হয়। আসুন বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক মহাদেবের ত্রিনয়ন সৃষ্টির রহস্য।

ত্রিনয়ন নিয়ে নানা পৌরাণিক কথা :

পুরাণ কাহিনী অনুসারে,মহাদেবের প্রথম স্ত্রী ছিলেন সতী। সতীর পিতা দক্ষরাজ। একদিন এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন সতীর পিতা ব্রহ্ম প্রজাপতি দক্ষ। সেখানে আমন্ত্রিত হন সতী সহ ভোলানাথ। আর সেখানে সতীর সামনেই মহাদেবকে তীব্র অপমানিত করেন দক্ষ। পিতার দ্বারা নিজের স্বামীর এই অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী যজ্ঞের আগুনে আত্মত্যাগ করেন। আর তা দেখে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়েন ভোলানাথ। প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে প্রচণ্ড তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেন। এই তাণ্ডবের ফলে সৃষ্টি যায় যায় অবস্থা হয়। তখন বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে ফেলেন। সতীর দেহের বিভিন্ন টুকরো যেখানে যেখানে পড়ে, সেখানেই গড়ে ওঠে সতীপীঠ। এই ঘটনার পর মহাদেব ধ্যানমগ্ন হন। তন্মধ্যে সতীর পুনর্জন্ম হয় হিমালয়পুত্রী হিসেবে। এরপর হিমালয়ের কন্যা পার্বতী মহাদেবের প্রণয়ে মুগ্ধ হন।কিন্তু শিব ধ্যানে মগ্ন। তিনি এতটাই ধ্যানমগ্ন ছিলেন যে জগতের কোনো কিছুতেই তাঁর আগ্রহ ছিল না। তবে অপরদিকে দেবতারা মহাদেবের ভ্যান ভঙ্গ করতে চেয়েছিলেন। তারা চেয়েছিলেন শীঘ্রই ভোলেনাথ এবং সতীর মিলন হোক । কিন্তু সব চেষ্টার পরও যখন দেবতারা শিবের ধ্যান ভঙ্গ করতে বিফল হয়। তখন তাঁরা কামদেবের সাহায্য নেন ।

মহাদেবের ধ্যান ভগ্ন করার জন্য লোভ-লালসার দেবতা কামদেব নানা পন্থা অবলম্বন করেন। কিন্তু সব চেষ্টাই বিফলে যাচ্ছিল। তখন একদিন কামদেব ঠিক করেন তিনি শিবের হৃদয়ে পুষ্পবান চালাবেন। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে একদিন আম গাছের আড়াল থেকে ধ্যানমগ্ন শিবের হৃদয়ে পুষ্পবান মারেন কামদেব। তা শিবের হৃদয়ে গিয়ে লাগে, ধ্যান ভাঙে শিবের। শুধু ধ্যানভঙ্গ নয়, সেই সময়ে সৃষ্টি হয় ত্রিনয়ন (Third Eye of Shiva)। ক্রুব্ধ অবস্থায় মহাদেব সেই ত্রিনয়ন দিয়েই ভষ্ম করে দেন কামদেবকে। এরপর স্বামীর পুনর্জীবন চেয়ে প্রার্থনা করেন কামদেবের স্ত্রী রতি। কামদেবের স্ত্রীর প্রার্থনায় সন্তুষ্ট শিব জানান, দ্রাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণের পুত্র হিসেবে জন্ম নেবেন কামদেব। এভাবেই কামদেবের প্রাণ ফিরিয়ে দেন মহাদেব।

এছাড়াও অপর একটি পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায়, একদা ধ্যানে মগ্ন ছিলেন মহাদেব। তখন দেবী পার্বতী হঠাৎ করেই তার দুই হাত দিয়ে ধ্যানমগ্ন শিবের দুটি চোখ চেপে ধরেন। অজান্তে পার্বতীর এই ভুলে তৎক্ষণাৎ গোটা পৃথিবী কালো মেঘে ঢেকে অন্ধকারময় হয়ে যায়। পৃথিবীর অন্ধকারময়তা কাটানোর জন্য এবং সৃষ্টিকে রক্ষা করতে মহাদেব তাঁর তৃতীয় নয়ন মেলেন। তাঁর ত্রিনয়নের মাধ্যমে পৃথিবী আলোকময় হয়ে ওঠে। গোটা দুনিয়ায় তখন আলোর প্রকাশ। তপ্ত ধরাতল। এই দেখে মহাদেবের দুই চোখ থেকে হাত সরিয়ে নেন পার্বতী। স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরে ভুবন। আর সেখান থেকেই বোঝা যায় মহাদেবের একটি চোখ যেমন সূর্যসমান তেমনি একটি চন্দ্র। এছাড়াও বলা হয়ে থাকে সেই সময় পার্বতীর হাত থেকে এক ফোঁটা ঘাম মাটিতে পড়ে এবং সেখান থেকে জন্ম হয় অন্ধক নামে এক রাক্ষসের।

মহাদেবের এই ত্রিনয়নের দিব্যদৃষ্টি কিসের প্রতীক

মহাদেবের এই তৃতীয় চক্ষু (Third Eye of Shiva) হলো শক্তির প্রতীক। যে চোখ থেকে জগতের কোনো কার্যকলাপ ফাঁক যায় না। শোনা যায় মহাদেব এই ত্রিনয়নের মাধ্যমে গোটা দুনিয়ার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎের ছবি পরিলক্ষিত হয়। তাঁর এই ত্রিনয়নের মাধ্যমে গোটা বিশ্বের সবকিছু পর্যবেক্ষিত হয়। মহাদেবের এই দিব্যদৃষ্টিকে জ্ঞানচক্ষুও বলা হয়। মহেশ্বরের এই চোখ অত্যন্ত শক্তিশালী। জানা যায় এই চোখ যদি মহেশ্বর খোলেন তাহলে জগত ধ্বংস হয়ে যেতে পারে অর্থাৎ মহাদেবের এই ত্রিনয়নে যে শক্তি রয়েছে যা কোনো স্বাভাবিক চোখে নেই।